নগরীর ৫০ হাজার বৈদুতিক খুঁটিতে ডিশ-ইন্টারনেটের ক্যাবল ।। শর্ট সার্কিট থেকে প্রায় দুর্ঘটনা
নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজারের সাথে জহুর হকার মার্কেটের সংযোগ ফুটওভার ব্রিজ। ব্রিজের নিচে মাথার ওপর ঝুলছে ইন্টারনেট ও ডিশের হাজার হাজার ক্যাবল। নিচে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য, চলছে হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত। কোনোটি হাতের কাছে, কোনোটি মাত্র ১০-১৫ ফুট মাথার উপরে ঝুলছে। এসব ক্যাবলে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটে ঘটে যেতে পারে অপ্রত্যাশিত যেকোনো প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। শুধু রেয়াজউদ্দিন বাজার নয়, একই চিত্র নগরীর অলিগলি থেকে শুরু করে ব্যস্ততম সড়ক, সবখানেই।
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ক্লিন ও গ্রিন সিটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্লিন সিটির ঘোষণা ছিল নগরপিতার নির্বাচনী ইশতেহারেও। ইতোমধ্যে নগরীকে সাজানোর জন্য অনেক প্রকল্পও হাতে নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। সবুজায়ন, সৌন্দর্য বর্ধনসহ নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও হয়নি নগরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইন্টারনেট ও ডিশ ক্যাবল নিয়ন্ত্রণ। নগরীতে ৫০ হাজার বৈদ্যুতিক খুঁটিতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঝুলছে অনুমোদনহীন এসব ক্যাবল। এগুলো দাহ্য পদার্থ হওয়ায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পুরো নগরীকে অগ্নিঝুঁকিতে ফেলেছে এসব ক্যাবল। কিন্তু এর পরেও নিয়ন্ত্রণে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা না থাকায় ক্ষোভ ছড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন- নগরজুড়ে এসব জঞ্জাল সরাবে কে?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইন্টারনেট ও ডিশের ক্যাবলগুলোর মধ্যেই অসংখ্য ক্যাবল রয়েছে অভিভাবকহীন। বিশেষ করে একসময়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের ক্যাবলের সাথে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদেরও অসংখ্য ক্যাবল রয়েছে। প্রশাসনের নজরদারির কারণে ভিওআইপি ব্যবসা কমে এলেও সরানো হয়নি এসব ক্যাবল। এতে নগরীতে ঝুলে থাকা ক্যাবলগুলোর মধ্যে অব্যহৃত ক্যাবলের সংখ্যাও অনেক।
এদিকে গত ২০ ডিসেম্বর নগরীর ব্যস্ততম জামালখান এলাকায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে ইন্টারনেট ক্যাবলে আগুন ছড়িয়ে লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও নিচে থাকা একটি প্রাইভেট কার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু জামালখান নয়, নগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রায়শ শর্ট সার্কিটে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে মাকড়সার জালের মতো প্যাঁচানো এসব ক্যাবলে আগুন ধরে যায়।
পিডিবি দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার প্রবীর কুমার সেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, নগরীতে প্রায় ৫০ হাজার খুঁটিতে ইন্টারনেট ও ডিশের ক্যাবল রয়েছে। এসব ক্যাবলের কারণে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটে। ক্যাবলের জঞ্জালের কারণে আমাদের বৈদ্যুতিক লাইনেও কাজ করতে হিমশিম খেতে হয়। তিনি বলেন, নগরীর বিভিন্ন জায়গায় পিডিবি এসব ক্যাবল কেটে দেয়। কিন্তু পরের দিনেই তা আবার ঝুলানো হয়। অথচ বৈদ্যুতিক খুঁটি পিডিবি ও সরকারি সম্পদ। সরকারি সম্পদ ব্যবহার করেই অবৈধভাবে ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসায়ীরা তাদের ক্যাবল ঝুলাচ্ছেন।
ক্যাবলের এসব জঞ্জালকে ‘কাকের বাসা’ আখ্যা দিয়ে চট্টগ্রামে শীর্ষ আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিসিএলের (চিটাগাং ক্যাবল লিমিটেড) পরিচালক শ্যামল কুমার পালিত দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামে ক্যাবল সেবা প্রদানকারীদের কোনো সংগঠন নেই। নগরীতে বিশৃংখলভাবে ক্যাবলগুলো আছে। আমরা চাই এগুলো সুশৃংখল হোক, যাতে সাধারণ মানুষকে বিপত্তিতে পড়তে না হয়। এখানে ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্কের চেয়ে ইন্টারনেট সেবাদানকারীদের (আইএসপি) ক্যাবল বেশি। এর মধ্যে অনেকের আইএসপির লাইসেন্সও নেই। আবার অনেক ক্যাবলের মালিকও নেই।
তিনি বলেন, এসব ক্যাবল সুশৃংখল করা প্রয়োজন। সিটি কর্পোরেশন এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলে আমরা সহযোগিতা করব। ক্যাবলগুলো কিভাবে টানব সেটা যদি নির্দিষ্ট করে দেয়, সে অনুযায়ী আমরা পদক্ষেপ নেব। আমরা সবসময় প্রশাসনের ডাকে সাড়া দিই। কিন্তু লাইসেন্সবিহীন আইএসপিগুলোকে পাওয়া যায় না। তাদের তারগুলো কোথায়, কেন টানছে সেটাও কেউ জানে না। এখানে অনেক পরিত্যক্ত ক্যাবল রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত চট্টগ্রামে পরিচালিত ফায়ার সার্ভিসের এক জরিপে নগরীর ৪২টি এলাকাকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের আওতায় ঝাউতলা বস্তি, আমবাগান বস্তি, সেগুনবাগান বস্তি, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাপুর সমবায় সমিতি মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, কালুরঘাট ফায়ার সার্ভিস এলাকায়, বহদ্দারহাট হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বকতেয়ার মার্কেট, নজুমিয়া হাট মার্কেট, বলিরহাট মার্কেট, চাক্তাই ফায়ার স্টেশনের আওতায় ভেড়া মার্কেট, চালপট্টি, শুটকিপট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, মিয়া খান নগর পুরাতন ঝুট মার্কেট, ওমর আলী মার্কেট, বন্দর এলাকার মধ্যে পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, ইশান মিস্ত্রি বাজার মার্কেট, ফকির হাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্যাতলী বাজার, ইপিজেড ফায়ার স্টেশনের আওতায় চৌধুরী মার্কেট, রেলওয়ে বস্তি, কলসী দিঘির পাড় এলাকার কলোনি, আকমল আলী রোড এলাকাধীন কলোনি, চন্দনপুরা ফায়ার সার্ভিসের চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিং মল, গুলজার মার্কেট, নন্দকানন ফায়ার সার্ভিসের আওতায় রিয়াজ উদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, টেরীবাজার, তামাকুমন্ডি লেন, বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের আওতায় ২ নং গেট রেলওয়ে বস্তি, ড্রাইভার কলোনি, অঙিজেন রাস্তা সংলগ্ন বস্তি, বার্মা কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি, শেরশাহ কলোনিকে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার এসব স্পটের বেশ কয়েকটির আওতায় রয়েছে অসংখ্য মার্কেট ও বিপণী বিতান। এসব অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্পটে রয়েছে ইন্টারন্টে ও ডিশের ক্যাবলের জঞ্জাল।
তথ্যমতে, শুধুমাত্র রেয়াজ উদ্দিন বাজারেই ছোট-বড় ১২৮টি মার্কেটে ১০ হাজারের অধিক দোকান রয়েছে। এছাড়া তামাকুমন্ডি লেইনের অধীনে ১১০টি মার্কেটে প্রায় ১০ হাজার দোকান রয়েছে। টেরীবাজারে ছোট-বড় প্রায় ৮৫টি মার্কেটে রয়েছে প্রায় দুই হাজার দোকান। জহুর হকার্স মার্কেটে রয়েছে প্রায় ৮ শতাধিক দোকান। তাছাড়া পুরো নগরীতে রয়েছে কয়েক হাজার বাণিজ্যিক স্থাপনা; যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা হয়।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রায় ১২শর অধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ২০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এসব অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগই হয়েছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ম্যানেজার কফিল উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, কয়েক মাস আগে চান্দগাঁও আবাসিকে একটি আগুন নির্বাপণে গিয়ে দেখতে পাই, আগুনের সূত্রপাত বাসার বাইরের বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে। কিন্তু ইন্টারনেট তারের সাথে আগুন বাসায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল। মাঝে মধ্যে নগরীর বিভিন্ন স্থানে এসব ক্যাবলে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, ক্যাবলগুলো কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি। যে কারণে ইন্টারনেট ক্যাবলের সাথে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডগুলোকে আমরা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট লিখি।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামশুদ্দোহা দৈনিক আজাদীকে বলেন, অপারেটরগুলোর ঝুলন্ত ক্যাবল শৃংখলায় আনার ব্যাপারে এখনো তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। তবে সুখবর হচ্ছে, পিডিবি মাটির নিচ দিয়ে তাদের লাইন নেওয়ার পদক্ষেপ শুরু করেছে। এতে বৈদ্যুতিক খুঁটি উঠে গেলে ক্যাবলগুলোও সরে যাবে। কারণ বেশিরভাগ ক্যাবলই বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে। তাছাড়া তারবিহীন ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক সেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। তিনি মনে করেন, এতে করে এসব ক্যাবল কমে যাবে।